ছোট গল্প : হয়তো কল্পনা হয়তো বাস্তব
লিখেছেন লিখেছেন আমীর আজম ০৯ জুলাই, ২০১৫, ০১:০৩:৩৪ রাত
দরজার খট খট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল রাবেয়া বেগমের। লাইট জ্বালালেন। সামনের দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালেন। রাত 2:30।
চুপচাপ শুয়ে আছেন তিনি। এক মিনিট পর আবার খটখট। এক মিনিট পর আবার খটখট।
নিশ্চিত হলেন তিনি। এই শব্দটা তার কাছে অনেক বেশী পরিচিত। অনেক আপন।
তার স্বামী রশিদ সাহেব। স্থানীয় একটি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক তিনি। বিয়ের পর থেকেই দেখতেছেন। অত্যন্ত ভদ্র আর অমায়িক মানুষ । মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয়ে যান। এ যুগে মানুষ এতটা ভাল হয় কিভাবে।
কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে তার। যেমনঃ বাড়িতে আসলে দরজায় সবসময় দুটো করে টোকা দেন। কিছুক্ষণ পর আবার দুটো। এভাবে চলতেই থাকে।
প্রথম প্রথম অবশ্য কিছুটা সমস্যা হতো। একদিন রাতে টানা আধা ঘন্টার মতো বাইরে দাড়িয়ে থাকতে হয়। রাবেয়া বেগম কিছুটা রেগে গিয়ে বলেন :
- আর একটু জোরে টোকা দিতে পার না। এত মৃদু শব্দে কি ঘুম ভাঙে।
- আমি আসলে তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।
- আজব কথা। তুমি শব্দ করলে আমি কষ্ট পাব কেন.?
- হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া কষ্টকর না। আর পাশে প্রতিবেশীরা আছে। তাদেরও তো সমস্যা হবে।
রাবেয়া বেগম বুঝতে পারেন। এই লোকের পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাকেই পরিবর্তিত হতে হবে। এখন আর কোন সমস্যা হয় না। একটু শব্দ করলেই তিনি জেগে উঠেন।
দরজা খুলে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন রাবেয়া বেগম। প্রায় একমাস পর দেখা হলো। কোথায় থাকেন, কিভাবে থাকেন কিছুই বলেন না। শুধু মাঝে মাঝে বিভিন্ন নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে বাসার খোঁজ খবর নেন।
সহ্য করতে পারেন না রাবেয়া বেগম। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। জিজ্ঞেস করেন, ' আর কতোদিন চলবে এভাবে বলতে পার। আমি যে আর পারছি না। '
রশীদ সাহেব কিছু বলতে পারেন না। চুপচাপ চিন্তা করতে থাকেন। কি যে কঠিন পরীক্ষায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের ফেলেছেন।
গত বছর তার ছোট ছেলে মিছিল করার সময় পুলিশের গুলিতে আহত হয়। এরপর হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। ছেলের লাশ নেয়ার জন্য হাসপাতালে যেতে পারেননি তিনি।
পরে বাবা হয়ে ছেলের লাশ কিভাবে কাধে বয়ে নিয়ে গেছেন, কিভাবে ছেলের জানাজা পড়িয়েছেন, কিভাবে ছেলের লাশ যে কবরে নামিয়েছেন তা কেবল আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই জানেন।
এ বছর তার বড় ছেলেকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এইচ. এস. সি. পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে। এখনো জালিমের কারাগারে বন্দী আছে সে। বাবা হয়ে এখনো ছেলের সাথে দেখা করতে পারেননি তিনি।
গতকালও এসেছিল যৌথ বাহিনীর
লোকজন। তাকে না পেয়ে বাসার
সবাইকে শাসিয়ে গেছে। তাদের সাথে
ছিল কিছু মুখোশ পড়া লোক। তারা
বাসার সব জিনিসপত্র ভেঙে - চুড়ে
দিয়েছে। টিভি, ফ্রিজ কিছুই বাদ
যায়নি তাদের কাছ থেকে। তার নামে মামলা আছে পঞ্চাশ টিরও বেশি।
কি অপরাধ ছিল তার। তার এই ফুটফুটে ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশু গুলোর। ইসলামের পথে অবিচল থাকা। ইসলামী আন্দোলন করাই কারণেই কি তার সন্তানদের এই করুণ পরিনতি।
তাই যদি হয়। তাহলে এরকম শত শত ছেলের জীবনের বিনিময়ে হলেও তিনি এই পথ থেকে এক বিন্দু পরিমাণ পিছপা হবেন না।
স্ত্রীকে বোঝান রশীদ সাহেব : ' তুমি কি মুসলমান নও.? ইসলামের ইতিহাস কি তোমার জানা নাই.? যুগে যুগে নবী রাসুলদের কাহিনি, সাহাবীদের আত্মত্যাগ কি তোমার জানা নাই.? জালিমদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাহাবীগণ যখন আল্লাহর রাসুলকে জিজ্ঞেস করেছিল আল্লাহর সাহায্য আর কতদূর.? তখন তিনি কী বলেন নাই, আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে। '
কিছুটা যেন স্বান্তনা পান রাবেয়া বেগম। কিন্তু তার বুকের ভিতর যে আগুন জ্বলছে সে আগুন নেভানোর মতো স্বান্তনা বাণী কি পৃথিবীতে আছে। কোন কবি, কোন সাহিত্যিক কি এখন পর্যন্ত এমন কোন ভাষা তৈরী করতে পেরেছে যা এই মায়ের মনকে শান্ত করতে পারবে।?
ইতিমধ্যে তার সাত বছরের ছোট্ট মেয়েটাও জেগে উঠেছে। ইদানিং সেও কেমন জানি সতর্ক হয়ে গেছে। মা বিছানা ছেড়ে উঠলে সেও কিভাবে জানি টের পেয়ে যায়। গতকালের তান্ডব তার চোখের সামনেই ঘটেছে।
অনেকদিন পর বাবাকে দেখে জড়িয়ে ধরে তাকে। চোখ মুখ দেখে মনে হয় যেন মনের ভিতর লুকিয়ে আছে অনেক কথা। বাবাকে জিজ্ঞেস করে :
- আচ্ছা বাবা, তুমি কি রাজাকার.?
- কেন মামনি ?
- কালকে যখন ওরা জিনিসপত্র ভাঙছিল, তখন বারবার তোমাকে রাজাকার বলে গালি দিচ্ছিল।
- না মামনি। আমি রাজাকার না।
- তাহলে ওরা বলতেছিল কেন.?
- কারণ ওরা আমাকে ভয় পায়।
মেয়ে হাসে। বলে :
- তোমাকে ভয় পাওয়ার কি আছে। কই আমি তো তোমাকে ভয় পাই না। বরং অনেক ভালবাসি।
- ওরা ভয় পায় আমার আদর্শকে। এই আদর্শের কারণে তোমার মতো সবাই আমাকে ভালবাসে। এটা ওদের সহ্য হয় না।
- কেন সহ্য হয় না বাবা ?
- কারণ তখন আর তাদেরকে কেউ ভালবাসবে না। তাদের ক্ষমতার মসনদ ভেঙে যাবে। তাই তারা চায় না কেউ আমার সংস্পর্শে আসুক। এজন্যে মিথ্যা বলে সবাইকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে।
- ও.! এবার বুঝতে পেরেছি।
- আচ্ছা মামনি, কালকে যখন ওরা এসেছিল তখন কি তুমি খুব ভয় পেয়েছিলে ?
- না বাবা। আমি একটুও ভয় পায়নি। আমার খুব ভাল লাগতেছিল।
- কেন মামনি ?
- কারণ এভাবেই তো মুসা ভাইয়ার সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়।
হকচকিয়ে যান রশীদ সাহেব। মেয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন :
- তোমার মুসা ভাইয়া আবার কে ?
- তুমি মুসা ভাইয়াকে চেন না ?
- না তো।
- তুমি দেখি কিচ্ছু জানোনা। আরে আহমদ মুসা। আবুল আসাদ স্যারের সাইমুম সিরিজের আহমদ মুসা। সিংকিয়াং, ফিলিস্তিন, মিন্দানাও, আর্মেনিয়ায় মুসলিম বিপ্লবের নায়ক। যেখানেই মুসলমানরা এরকম বিপদে পড়ে সেখানেই ছুটে যান তিনি।
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেন রশীদ সাহেব। চোখ দুটো অনেকদিন পর ঝাপসা হয়ে আসে তার। ঝাপসা চোখে খুঁজতে থাকেন। খুঁজতে থাকেন কল্পনার আহমদ মুসাকে বাস্তবে।
বিষয়: বিবিধ
১৩২০ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন